ভূতের গল্প - সুজন ওঝা - সুকুমার রায়

0




সুদন ছিল ভারী গরীব , তার এক্মুঠো অন্নের সংস্থান নাই । রোজ রোজ জুয়া খেলে লোককে ঠকিয়ে যা পায় , তাই দিয়ে কোনোরকমে তার কাজ চলে যায় । যেদিন যা উপায় করে, সেইদিনই তা খরচ করে ফেলে , একটি পয়সাও হাতে রাখে না । এই রকম কয়েক বছর কেটে গেল ; ক্রমে সুদানের জ্বালায় গ্রামের লোক অস্থির হয়ে পড়লো । পথে তাকে দেখলেই সকলে ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা দেয় । সে এমন  পাকা খেলােয়াড় যে কেউ তার সঙ্গে বাজি রেখে খেলতে চায় না। একদিন সূদন সকাল থেকে রাস্তায় ঘুরে বেরোচ্ছে, গ্রামময় ঘুরেও কাউকে দেখতে পেল না। ঘুরে ঘুরে নিরাশ হয়ে সূদন ভাবল—“শিব মন্দিরের।

পুরুতঠাকুর ত মন্দিরেই থাকে—যাই, তার সঙ্গেই আজ খেলব।” এই ভেবে সূদন সেই মন্দিরে চলল। দূর থেকে সূদনকে দেখেই পুরুত ঠাকুর ব্যাপার বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি মন্দিরের অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ল। মন্দিরের পুরুতকে না দেখতে পেয়ে সূদন একটু দমে গেল বটে, কিন্তু তখনই স্থির

করল—“যাঃ—তবে আজ মহাদেবের সঙ্গেই খেলব। তখন মূর্তির সামনে গিয়ে বলল—“ঠাকুর! সারাদিন ঘুরে ঘুরে এমন একজনকেও পেলাম না,

যার সঙ্গে খেলি! রােজগারের আর কোন উপায়ও আমি জানি না, তাই এখন তােমার সঙ্গেই খেলব। আমি যদি হারি, তােমার মন্দিরের জন্য খুব ভাল একটি দাসী এনে দিব, আর তুমি যদি হার, তবে তুমি আমাকে একটি অপ্সরা মেয়ে দিবে—আমি তাকে বিয়ে করব” । 

এই বলে সূদন মন্দিরের মধ্যে ঘুটি পেতে খেলতে বসে গেল। খেলার দান ন্যায়মতাে দুই পক্ষই সূদন দিচ্ছে—একবার

নিজের হয়ে একবার দেবতার হয়ে খেলছে! অনেকক্ষণ খেলার পর শেষে

সূদনেরই জিত হল। তখন সে বলল—“ঠাকুর। এখন ত আমি বাজি জিতেছি, এবার পণ দাও।” পাথরের মহাদেব কোন উত্তর দিলেন না। একেবারে নির্বাক

রইলেন। তা দেখে সূদনের হল রাগ। “বটে! কথার উত্তর দাও না কেমন দেখে নেব”—এই বলেই সে করল কি, মহাদেবের সম্মুখে যে দেবীমূর্তি ছিল সেটি

তুলে নিয়েই উঠে দৌড়।

সূদনের স্পর্ধা দেখে মহাদেব ত একেবারে অবাক! তখনি ডেকে বললেন - “আরে, আরে, করিস কি? শীগগির দেবীকে রেখে যা। কাল ভােরবেলা যখন

মন্দিরে কেউ থাকবে না, তখন আসিস, তােকে পণ দিব।” এ কথায় সূদন দেবীকে ঠিক জায়গায় রেখে চলে গেল।

এখন হয়েছে কি, সেই রাতে একদল স্বর্গের অপ্সরা এল মন্দিরে পুজো দিতে । পুজোর পর 

সুন্দর এক বাড়ি তৈরী করল। সেই বাড়িতে তারা পরম সুখে থাকতে লাগল। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল! সপ্তাহে একদিন, রাত্রে অপ্সরাদের সকলকে ইন্দ্রের সভায় থাকতে হয়। সেই দিন উপস্থিত হলে, রম্ভা যখন ইন্দ্রের সভায় যেতে চাইল, তখন সূদন বললে-- “আমাকে সঙ্গে না নিলে কিছুতেই যেতে দেব না।” মহা মুশকিল। ইন্দ্রের সভায় গেলেও সর্বনাশ—দেবতাদের নাচ গান সব বন্ধ হয়ে যাবে—আবার সূদনও কিছুতেই ছাড়ছে না। তখন রম্ভা মায়াবলে সূদনকে একটা মালা বানিয়ে গলায় পরে নিয়ে ইন্দ্রের সভায় চলল। সভায় গিয়ে সূদনকে মানুষ করে দিলে পরে, সে এক কোণে লুকিয়ে বসে সব দেখতে লাগল। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হলে, নাচগান সব থেমে গেল। রম্ভা সূদনকে আবার মালা বানিয়ে গলায় পরে চলল তার বাড়িতে। বাড়ির কাছে একটা নদীর কাছে এসে রম্ভা তাকে আবার মানুষ করে। দিল, তখন সূদন বলল—“তুমি বাড়ি যাও, আমি এই নদীতে স্নান ও আহ্নিক করে পরে যাচ্ছি।”

এই নদীর ধারে ছিল ত্রিভুবন তীর্থ। এখানে দেবতারা পর্যন্ত স্নান করতে আসতেন। সেদিন সকালেও ছােটোখাটো অনেক দেবতা নদীর ঘাটে স্নান করছিলেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেখে সূদন চিনতে পারল—তারা রাত্রে ইন্দ্রের সভায় রম্ভাকে খুব খাতির করছিলেন। সূদন ভাবল—“আমার স্ত্রীকে এরা

এত সম্মান করে তাহলে আমাকে কেন করবে না ? এই ভেবে সে খুব গম্ভীর ভাবে তাদের সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াল। যেন সেও ভারী একজন দেবতা। কিন্তু

দেবতারা তাকে দেখে অত্যন্ত অবজ্ঞা করে তার দিকে ফিরেও চাইলেন না। তারা তাদের স্নান ও আহ্নিকেই মন দিলেন। এ তাচ্ছিল্য সূদনের সহ্য হল না।

সে করল কি, একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে দেবতাদের বেদম প্রহার দিয়ে বলল—“এতবড় আম্পর্ধা! আমি রম্ভার স্বামী, আমাকে তােরা জানিস নে ?”

দেবতারা মার খেয়ে ভাবলেন ' কি আশ্চর্য! রম্ভা কি তবে মানুষ বিয়ে করেছে?

তারা তখনই স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রের কাছে সব কথা বললেন।


তাকে লুকিয়ে স্বর্গে এনে আমার সভায় নাচ দেখিয়েছ এবং স্পর্ধা করে সেই লােক আবার দেবতাদের গায়ে হাত তুলেছে ও অতএব, আমার শাপে তুমি আজ

হতে দানবী হও। বারাণসীতে বিশ্বেশ্বরের যে সাতটি মন্দির আছে সেই মন্দির চুরমার করে আবার যতদিন কেউ নতুন করে গড়িয়ে না দেবে, ততদিন তােমার

শাপ দূর হবে না। রম্ভা তখনি পৃথিবীতে এসে সূদনকে শাপের কথা জানিয়ে বলল—“আমি এখন দানবী হয়ে বারাণসী যাব। সেখানে বারাণসীর রাজকুমারীর শরীরে ঢুকব, আর লােকে বলবে রাজকুমারীকে ভূতে পেয়েছে। রাজা নিশ্চয়ই যত ওঝা কবিরাজ ডেকে চিকিৎসা করাবেন; কিন্তু আমি তাকে ছাড়ব না, তাই কেউ রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে না। এদিকে তুমি বারাণসী গিয়ে বলবে যে, তুমি রাজকুমারীকে আরাম করতে পারাে। তারপর তুমি বুদ্ধি করে ভূত ঝাড়ানাের চিকিৎসা আরম্ভ করলে আমি একটু একটু করে রাজকুমারীকে ছাড়তে থাকব। তারপর তুমি রাজাকে বলবে যে, তিনি বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চূর্ণ করে, আবার। যদি নূতন করে গড়িয়ে দেন। তবেই রাজকুমারী সম্পূর্ণ সুস্থ হবেন। রাজা অবশ্য তাই করবেন আর তাহলেই আমার শাপ দূর হবে। তুমিও অগাধ টাকা পুরস্কার পেয়ে সুখে স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে।” এই কথা বলতে বলতেই রম্ভা হঠাৎ দানবী। হয়ে, তখনই চক্ষের নিমেষে বারাণসী গিয়ে একেবারে রাজকুমারীকে আশ্রয় করে বসল।

রাজকুমারী একেবারে উন্মা দ পাগল হয়ে, বিড় বিড় করে বকতে বকতে সেই যে ছুটে বেরুলেন, আর বাড়িতে ঢুকলেনই না। তিনি শহরের কাছেই একটা

গুহার মধ্যে থাকেন, আর রাস্তা দিয়ে লােকজন যারা চলে তাদের গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারেন। রাজা কত ওঝা বদ্যি ডাকলেন, রাজকুমারীর কোন উপকারই হলাে না। শেষে রাজা তেঁড়া পিটিয়ে দিলেন,—“যে রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিব—রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিব।”

রাজবাড়ীর দরজার সামনে ঘন্টা ঝুলান আছে, নতুন ওঝা এলেই ঘ করে হিজিবিজি মন্ত্র পড়াও বাদ দিল না। যজ্ঞ শেষ করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই

পর্বতের গুহায় চলল, যেখানে রাজকন্যা থাকে। সেখানে গিয়েও বিড় বিড় করে খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ল—“ভূতের বাপ-ভূতের মা—ভূতের ঝি, ভূতের

ছা—দূর দূর দূর, পালিয়ে যা।” ক্ৰমে সকলে দেখল যে, ওঝার ওষুধে একটু একটু করে কাজ দিচ্ছে। কিন্তু ভূত রাজকুমারীকে একেবারে ছাড়ল না। তিনি তখনও গুহার ভিতরেই থাকেন, কিছুতেই বাইরে আসলেন না। যা হােক, রাজা সূদনকে খুব আদর যত্ন করলেন, আর, যাতে ভূতে একেবারে ছেড়ে যায়, সেরূপ ব্যবস্থা করতে অনুরােধ করলেন। দুদিন পর্যন্ত সূদন আরও কত কিছু ভড়ং করল। তৃতীয় দিনে সে রাজার কাছে এসে বলল—“মহারাজ! রাজকুমারীর ভূত বড় সহজ ভূত নয়—এ হচ্ছে দৈবী ভূত। মহারাজ যদি এক অসম্ভব কাজ করতে পারেন-বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুরমার করে, আবার নূতন করে ঠিক আগের মতাে গড়িয়ে দিতে পারেন,তবেই আমি রাজকন্যাকে আরাম করতে পারি।” রাজা বলতে স—“এ আর অসম্ভব কি?” রাজার হুকুমে তখনই হাজার হাজার লােক লেগে গেল। দেখতে দেখতে মন্দিরগুলি চুরমার হয়ে গেল। তারপর একমাসের মধ্যে আবার সেই সাতটি মন্দির ঠিক যেমন ছিল তেমনটি করে, নতুন মন্দির গড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও সেরে উঠলেন, অপ্সরাও শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল। তারপর খুব ঘটা করে সূদনের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হল আর রাজা বিয়ের যৌতুক দিলেন তার অর্ধেক রাজত্ব।


Tags

Bhuter Golpo , Bangla Bhuter Golpo , Ghost Story in Bengali 

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top