ভৌতিক - হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

0


| ভূত আছে কি নেই এ তর্ক বহুদিনের। ভগবানের অস্তিত্ব নিয়েও এ ধরনের। তর্ক আদিম যুগ থেকে চলে আসছে। দুটো তর্কেরই আজও নিষ্পত্তি হয়নি। বিজ্ঞানের যুগে তােমরা হয়তাে এসব মানতে চাইবে না। অণুবীক্ষণ আর দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যা দেখা যায় না, তার অস্তিত্বও নেই, এই তােমাদের মত। ভূতের কথা তােমাদের মতন এতদিন আমিও বিশ্বাস করতাম না। অনেক জায়গায় ভূত দেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। পােড়ড়া বাড়িতে রাত কাটিয়েছি, ঘাের অমাবস্যায় শ্মশানে ঘােরাফেরা করেছি। কিছু চামচিকে আর শেয়াল ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি। ভূত সম্বন্ধে আমিও ঘােরতর অবিশ্বাসী হয়ে উঠছিলাম, এমন সময় ব্যাপারটা ঘটল। ঠিক আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে সময় রায়। ছেলেটি দেখতে যেমন

সুন্দর, লেখাপড়াতেও তেমনই উৎসাহী। বি. এ. পরীক্ষা দেবার আগে মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়তে আসত। সেই সময়ে তার বিদ্যাবুদ্ধি পরখ করার সুযােগ  আমার হয়েছিল। তা ছাড়া একেবারে পাশের বাড়িতে থাকত, খুব ছােটোবেলা থেকেই তাকে দেখছি।

ইদানীং অনেকদিন সমরের সঙ্গে দেখা হয়নি। শুনেছিলাম পরীক্ষার পর সে বাইরে কোথায় বেড়াতে গেছে। এক সন্ধ্যায় ঘরে বসে একটা বই পড়ছি। বাইরে ঝড়ের আভাস। জানালা, দরজার পর্দাগুলাে দমকা বাতাসে উড়ছে। দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও যেন গায়ে এলে পড়ল, কিন্তু বইটা এত ভাল লাগছিল যে উঠে গিয়ে জানালাগুলাে বন্ধ করতেই

ইচ্ছে করছিল না।

হঠাৎ সশব্দে দরজাটা খুলে গেল। ভাবলাম ঝড়। চোখ ফিরিয়েই কিন্তু।

অবাক হলাম। সমর এসে দাঁড়িয়েছে। উস্কখুস্ক চুল, পাংশু মুখ।

কি সমর, কবে ফিরলে? বইটা মুড়ে প্রশ্ন করলাম।

সমর কৌচে, আমার পাশে বসে বলল, এই একটু আগে। জামা কাপড় ছেড়েই আপনার কাছে চলে আসছি।

কি ব্যাপার ? মনে হল সমরের বােধ হয় জরুরী কোন কথা বলবার আছে।

আপনার সময় হবে এখন? আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।

হাসলাম, অফুরন্ত সময়। বল কি তােমার কথা ?

আপনি ভূত বিশ্বাস করেন মাস্টারমশাই? এ প্রশ্ন হাজার বার হাজার

জায়গায় শুনেছি। সােজাসুজি উত্তর না দিয়ে বললাম, কি বলতে চাইছ বল?

মৃত্যুর পর মানুষ শেষ হয়ে যায় না মাস্টারমশাই। ভূত বলুন আত্মা বলুন,

তারা আছে। মাঝে মাঝে তারা দেখা দেয়।

বুঝলাম কোন কারণে সমর খুব উত্তেজিত হয়েছে। অনেকেরই রজ্জুতে

সর্পভ্রম হয়। আধাে অন্ধকারে গাছপালা দেখে ভূতপ্রেত কল্পনা করে, কিংবা

বদমাইশ লােকের প্রতারণায় ভুলে মনে করে অশরীরী কিছু একটা দেখেছে।

সমরের পিঠে হাত রেখে বললাম, মাথা ঠাণ্ডা করে কি হয়েছে বল তাে?

সমর কেঁচার খুঁট দিয়ে মুখ আর কপাল মুছে নিল তারপর একটু দম নিয়ে

বলতে আরম্ভ করল।

লক্ষেতে আমার এক পিসি আছেন আপনি জানেন বােধ হয় ? 

হ্যা, তােমার কাছেই শুনেছি। তিনি কোন এক স্কুলের শিক্ষিকা, তাই না?

তার কাছে আমাকে যেতে লিখছেন, কিন্তু একটার পর একটা ঝঞ্জাটের জন্য ।

সমর ঘাড় নাড়ল, পিসি বৈজনাথ শিক্ষাদানে পড়ান। তিনি অনেকদিন ধরে।

যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তাই পরীক্ষার পর ভাবলাম, এখন তাে প্রচুর অবসর,

এইবার ঘুরে আসি। মাসখানেক আগে দেরাদুন এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে গেলাম।

তােমার বাবার কাছে শুনেছি। আমি কৌচের ওপর পাদুটো তুলে ভাল হয়ে ।

আপনি শুনলে হাসবেন, জীবনে এই আমার প্রথম রেলযাত্রা। কাজেই ।

উৎসাহের অন্ত ছিল না। প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামতেই আমিও নেমে প্ল্যাটফরে

পায়চারি করতে আরম্ভ করি। গার্ডের হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে কামরায়

উঠি। কিন্তু এক স্টেশনে বিপদ ঘটল।

আমি সােজা হয়ে বসলাম, কি ট্রেন ছেড়ে দিল তাে ?

সমর আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বলতে লাগল, এক স্টেশনে নেমে

এদিক ওদিক বেড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখলাম একটি বছর আট-নয়েকের মেয়ে, বেশ পট 

ফুটফুটে চেহারা, কোঁকড়ানাে চুল, পরনে নীলচে রঙের একটা ফ্রক, আমাকে হাত

নেড়ে ডাকছে।

এত 

প্রথমে ভাবলাম আমারই ভুল হয়েছে। মেয়েটি বােধহয় অন্য কাউকে 

ডাকছে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম, না আর কেউতাে ধারে কাছে নেই। এর 

মেয়েটিকে বাঙালী বলেই মনে হল। প্ল্যাটফর্মের ওপর বেশীর ভাগই অন্য জাতের

জটলা। মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমায় সে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

ভাবলাম, বিদেশে মেয়েটি নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে। আমাকে স্বজাতি দেখে 

সাহায্য চাইছে।

মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, আমি এগােতে সে

চলতে শুরু করল স্টেশনের বিশ্রামকক্ষের দিকে। বুঝতে পারলাম, সম্ভবত

বিশ্রামকক্ষে তার কোন আত্মীয় বা আত্মীয়া বিপদে পড়েছেন কিংবা হঠাৎ অসুস্থ।

হয়েছেন। কিন্তু না, বিশ্রামকক্ষের সামনে একটু দাঁড়িয়ে মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে।

এ ধারে একটা বকুলগাছ। অজস্র বকুল ঝরে পড়েছে পথের ওপর। পাশে।

| আমি আর উৎকণ্ঠা দমন করতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হল?

আমি জোরে জোরে হেঁটে মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং ঠিক সময় ।

হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। এদিকে চেয়ে দেখি মেয়েটি উধাও। এ

স্ক 

আমাকে দেখে আবার হাত নেড়ে ডেকেই আরও এগিয়ে গেল।

স্টেশনের সীমানার রেলিং। মেয়েটি তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।


??????


নিমেষে যেন মুছে গেল। আমি ট্রেনের দিকে ছুটলাম কিন্তু ধরতে পারলাম না।

দুরন্ত গতিতে ট্রেন যেন আমার চেষ্টাকে উপহাস করতে করতে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণ পরে আমি হাসলাম। ওই তােমার ভৌতিক গল্প! মেয়েটি তােমায়

বােকা বানিয়ে সরে পড়েছে। বয়স কম হলে হবে কি, মেয়েটি ভারী ওস্তাদ মনে হচ্ছে।

সমর আমার হাসিতে যােগ দিল না। গম্ভীর গলায় বলল, আমার কাহিনী

এখনও শেষ হয়নি মাস্টারমশাই।

আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম। বললাম, বেশ, বলে যাও।

আমি স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে ট্রেন ফেল করার কথা বললাম।

তিনি পরের স্টেশনে ফোন করে দিলেন, যাতে তারা আমার বিছানা আর

সুটকেসটা নামিয়ে রাখতে পারে। এর পরের ট্রেন রাত সাড়ে নটায়। হাতে অঢেল

সমস্ত বিশ্রামকক্ষগুলাে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কয়েকজন দেহাতী যাত্রী বসে

আছে। মেয়েটি কোথাও নেই। স্টেশনের বাইরে কয়েকটা টাঙ্গাওয়ালাকে

মেয়েটির কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তারা কেউই কিছু বলতে পারল না।

আশ্চর্য লাগল, চোখের সামনে থেকে মেয়েটি কি করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল,

এই প্রচণ্ড দিনের আলােয় কোথায় সে সরে যেতে পারে!

আশ্চর্য হবার আমার আরও বাকি ছিল। রাত সাতটা নাগাদ সারা স্টেশনে

হই চই। সবাই খুব ব্যস্ত। গিয়ে খবর নিয়েই চমকে উঠলাম। দেরাদুন এক্সপ্রেসের

সঙ্গে এক মালগাড়ীর ভীষণ ধাক্কা লেগেছে। অনেক লােক আহত হয়েছে, মারা

গেছে বেশ কয়েকজন। আপাততঃ সব গাড়ি বন্ধ। দু একটা রিলিফ ট্রেন সাহায্য

নিয়ে ছােটাছুটি করছে। স্টেশন মাস্টারের কামরায় খুব ভিড়। অনেকেই

আত্মীয়স্বজনের খবর নেবার জন্য ব্যাকুল।

ভিড় কমতে খবর পেলাম, দেরাদুন এক্সপ্রেসের সামনের চারখানা বগি

একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। সামনের তিন নম্বরের বগিতে আমার থাকার

কথা। সেই মুহূর্তে নতুন করে আবার মেয়েটির কথা মনে এল। মেয়েটি যদি

হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকে না নিয়ে যেত, তাহলে আমার কি অবস্থা হত

ভেৱেই শিউরে � ??????


সারারাত মেয়েটির কথা ভাবলাম। বিধাতার আশীর্বাদের মতন মেয়েটি যেন ।

আমার প্রাণরক্ষা করতেই এসেছিল। কিন্তু কাজ শেষ করে মেয়েটি

মিলিয়ে গেল।

পরের দিন এগারােটা নাগাদ লক্ষে পৌছলাম। স্টেশনে পিসি এসেছিলেন।

খুব ছেলেবেলায় তাকে দেখেছিলাম, তবু চিনতে অসুবিধা হল না। পিসির চেহারা।

প্রায় একই রকম আছে।

প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, খবরের কাগজে টেন

দুর্ঘটনার খবর পড়ে আমার যা অবস্থা হয়েছিল। কেবল মনে হচ্ছিল, এর জন্য

যেন আমিই দায়ী। আমি বার বার তােকে আসতে লিখেছিলাম। তারপর তাের

টেলিগ্রামটা পেয়ে ধড়ে প্রাণ এল। কি ব্যাপার বল তাে?

সব ব্যাপারটা বললে পিসি হয়তাে বিশ্বাসই করতেন না। বিশেষ করে তিনি

যখন স্কুলে বিজ্ঞান পড়ান। কাজেই মেয়েটির ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়ে

বললাম, চা খেতে একটা স্টেশনে নামতে ট্রেন ছেড়ে দিল পিসি। ছুটে গিয়েও

ট্রেন ধরতে পারলাম না।

পিসি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবান তােকে বাঁচিয়েছেন, জন্ম জন্ম

যেন তাের চা খাওয়ার নেশাটা থাকে।

দুজনে টাঙ্গায় উঠলাম। প্রায় আধঘন্টার ওপর চলার পর একটা বাড়ির

সামনে টাঙ্গা থামল পিসির নির্দেশে।

পিসি নেমে চিৎকার করলেন, সুন্দর, সুন্দর। একটি ছােকরা নেমে এল।

আমার সুটকেস আর বিছানা নিয়ে আবার ওপরে উঠে গেল। পিসির পিছন পিছন

আমি ওপরে উঠলাম।

মাঝারি সাইজের একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে পিসি বললেন, ওই

ঘরটা তাের। যা জামা কাপড় ছেড়ে নে। আমি জলখাবারের বন্দোবস্ত করি।

শরীর খুবই ক্লান্ত ছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চেয়ারের ওপর নিজেকে ছেড়ে

দিলাম।

এক কোণে একটা টেবিল, তার ওপর বাতিদান। একটা আলনা, ছােট একটা

খাট। দেওয়ালে গােটা তিনেক ছবি। সামনের ছবিটার দিকে চাইতেই সমস্ত শরীর

| বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতন কেঁপে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে হল ভয়ের কালাে ।

একটা ছায়া আমাকে আবৃত করার চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি বাইরে ????


আবার ডাকলাম পিসি, ও পিসি।

এতক্ষণে আমার ডাক পিসির কানে পৌছল। হন্তদন্ত হয়ে পিসি সিঁড়ির কাছে।

লা

২।

একটু পরে। কি হল রে তাের ? শরীর খারাপ হয়নি তাে? এত ঘামছিস কেন?

শ্য

সার

"য়ে।

অ'

এসে বললেন, কিরে, কি হয়েছে?

একটু এ ঘরে এসাে তাে।

আমি ছুটে ওপরের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পিসিও এলেন

আমার ঠিক আছে। কিন্তু এ ছবিটা কার? এই যে?

জামার আস্তিন দিয়ে কপালের ঘামের বিন্দু মুছে ফেলে বললাম, না, শরীর

আমার মেয়ে টুনু।

হাত দিয়ে সামনের ফটোটা দেখালাম। পিসি বললেন, ওটা টুনুর ফটো।

- মেয়ে?

হ্যা, তাকে তুই দেখিসনি। তাের জন্মাবার বছর খানেক আগে টুনু মারা

গেছে। টাইফয়েডে। বােধহয় বছর আটেক হয়েছিল বয়স।

শেষদিকে পিসির কণ্ঠস্বর একটু গাঢ় হয়ে এল। কিন্তু ঠোটটা কামড়ে থেমে

গেলাম। কিন্তু কিরে, কি বলবি বল? পিসি বললেন।

—তুমি কি বিশ্বাস করবে পিসি? বিশ্বাস করবার কথা নয়।

কথাটা বল, তবে তাে বুঝব বিশ্বাস করার কথা কিনা। পিসি আমার ভাবভঙ্গী

দেখে রীতিমতাে বিস্মিত হলেন।

টুনুদির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে পিসি। আমার কথা শেষ হবার আগেই পিসি

ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ভাবলেন, নির্ঘাৎ ছেলেটার মাথা খারাপ হয়েছে।

একটু একটু করে সব বললাম। যখন শেষ করলাম, পিসির চোখ দিয়ে টসটস

করে জল পড়ছে। পিসি বিজ্ঞান পড়ান, কিন্তু একটি কথার প্রতিবাদ করলেন না, কিছু।

অবিশ্বাস করলেন না। শুধু বললেন টুনুই তাের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এবার সমর আমার দিকে ঘুরে বসল। বলুন মাস্টারমশাই কি করে এটা

সম্ভব? মারা যাবার পরও কি আত্মার স্নেহ, দয়া মায়ার আকর্ষণ থাকে? নিজের

আত্মীয়দের বাঁচাবার জন্য তারা কি মানুষের দেহ ধরে আবার ফিরে আসতে পারে

মরলােকে?

বাইরে ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমগাছের একটা ডাল জানলার

পাল্লায় মাথা ঠুকছে অনবরত। জলের ঝাপটায় ঘরের অনেকখানি ভিজে গিয়েছে।

সেই দিকে চেয়ে চুপ করে বসে র������������ 


Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top